সুরাইয়া জাহান শারমিনের আত্মহননের মধ্য দিয়ে জয় হয়েছিল ভালোবাসার, হার মেনেছিল সমস্ত জাতের’ অনতিক্রম্য বিভেদ সকল। জীবনের অসহায় বাস্তবতার কাছে প্রিয়তার পরাজয়, জীবনের পরাজয়, তাঁরই নীলাভ রক্তিম বহিঃপ্রকাশ–অখিল চন্দ্র দাসের কাছে লিখা, শ্রীকান্ত বাবুর একখানা পত্র ।
প্রিয় অখিল
আমার আশীর্বাদ নিও । দীর্ঘদিন তোমার সমাচার নেওয়া হয় না বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । আমার উপর আত্মিক অভিমান পুষে রেখো না । তুমি শুধু আমার বাল্যবন্ধুই না, তুমি আমার চোখের নোনা জলের অশরীরী আবেগ প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম, তুমি আমার অপরিপক্ক অনুভূতির অলিখিত আশ্রয় কেন্দ্র । লিখিত বলতে পারলাম না কেবল শারমিনের জন্য। শারমিনের প্রিয়তার কতটা দাস আমি তা কেবল তুমিই জানো, সেইজন্য শারমিনের মতোই আমি তোমাকে নিজের মনে করি ।
আমি ক্যালিফোর্নিয়াতে আছি প্রায় ১২ বছর অথচ একটি দিনও মনে হয়নি, আমি আমার আমিত্ববোধ থেকে দূরে আছি, আমিত্ববোধ বলতে আমি কাকে ইঙ্গিত করেছি তা তুমি ভালো করেই জানো যদিও সেই বোধের যৎসামান্য একটা অংশ তুমিও বৈকি । আচ্ছা অখিল, জাত’ শব্দটার মানেটা আসলে কী ? জাতিগত বিভেদ, সাম্প্রদায়িক বৈষম্য অথবা বিভিন্ন জাতের বিভেদ, বৈষম্য দ্বারা লালিত হয়ে বেঁচে থাকার বস্তুনিষ্ঠ সংজ্ঞা আসলে কী, আমাকে তুমি একটু বুঝিয়ে বলতে পারো ?
বন্ধু তুমিই বলো, জাতই’ যদি সবকিছুর নির্ণায়ক হয়ে থাকে তবে মানুষ’ শব্দটার কী প্রয়োজন ছিল ? আমি হিন্দুর ছেলে হওয়ার কারণে শারমিনের বাবা আমাদের বিয়েতে রাজি হল না আর শারমিনের বাবারই বা কিসের দোষ ? আমার বাবা অমিত গঙ্গোপাধ্যায়, আমাকে বলে দিলো, আমরা ব্রাহ্মণ-সুতারং আমাদের যা তা করলে চলবে না, আমরা নাকি সকল দেবতার দ্বারা অভিশপ্ত হব এবং এও বলল মুসলমানের মেয়েকে যদি তুমি বিয়ে করো তাহলে সেই বিয়ের দিনই তুমি আমার মুখে আগুন দিও । আর আমার মা’ তো পারলে প্রতিদিনই শীতলক্ষ্যায় ডুবে মরে ।
মাঝে মাঝে চোখের জলকে’ প্রশ্ন করতাম, এই নিষ্ঠুর বোধের জগতে এত মানবী থাকতে শারমিনের দাস কেন হলাম ? চোখের ভারী নোনা জল আমাকে জানিয়ে দিত–প্রেমের অদৃশ্য বোধকে আমি যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম তাহলে কখনোই আমি তোমায় শারমিনকে দেখাতাম না । বন্ধু আমার, তুমি জানো কীনা জানি না, আমি গোপনে মুসলমান হতে চেয়েছিলাম কিন্তু কিভাবে যেন বাবা টের পেয়ে গেলেন এবং সত্যি সত্যি তিনি ইঁদুর মারার বিষ খেলেন কিন্তু না, আমার পিতা অমিত গঙ্গোপাধ্যায় মরেননি, তিনি তাঁর ঈশ্বরপ্রদত্ত পাওয়া জাত’ এবং জাতের গরিমা নিয়ে এখনো দিব্যি বেঁচে আছেন ।
জাত জাত’ করে যাদের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল, তারা সবাই বেঁচে আছে শুধু আমার শারমিন ! বন্ধু, আমার কলম আর চলছে না, কালির বদলে চোখের জল দিয়ে যদি চিঠি লেখা যেত, বোধ করি তা করতে আমার তেমন কোন অসুবিধা হত না । আমার শারমিন, আমার জন্য বিষ খেয়ে মরে গেলো অথচ আমি কত সুন্দর বেঁচে আছি ! আবার মাঝে মাঝে আমি স্বপ্নও দেখি, কী ভয়ংকর দানব আমি, কতটা অমানুষ হলে এমনটা করা যায়, একবারো কী ভেবে দেখেছ ?
অখিল তোমার খবর কী ? বৌদি, তোমার সন্তানেরা কেমন আছে, প্রকাশ আর নিখিলের কী অবস্থা, তোমরা কী তিন ভাই একসাথেই আছ নাকি পশ্চিমাদের মতো স্বতন্ত্র বোধ’ তোমাদের পেয়ে বসেছে ?
বন্ধু, বন্ধু আমার, জগতে যত মানুষ দেখো–তাদের প্রত্যেকেরই স্বীয় একটা ভুবন আছে, আলাদা একটা চেতনার জটলা আছে, নিজস্ব একটা খোলা আদালত আছে এবং সেই আদালতের বিচারক সে নিজেই । আশ্চর্যজনক বিষয়টা হলো, সেই আদালতের সব রায় তাঁর পক্ষেই যায়, ভাবখানা এমন, সে যেন ফেরেশতা সমতুল্য অথবা ভুলের ঊর্ধ্বের একজন । ডাকাত যখন ডাকাতি করে তার সত্তায় একটিবারের জন্যও অপরাধের বোধ বাসা বাধে না, অপরাধকে অপরাধ মনে করে সম্পাদন করা মোটেও কোনো সহজ কাজ নয়, অখিল ।
কারো প্রতি আমার কোন অভিযোগ বা অনুযোগ নেই । আমার বাবা-মা হয়ত এখনো জানে, তারা ঠিক কাজটিই করেছে আবার আমার বোধই যে সঠিক তাও বলা যাবে না । হয়ত বিধাতা আমাদের অন্তর্যামী কল্যাণের কথা ভেবেই এমন জটিল সমীকরণগুলো তাঁর স্বীয় নিয়ন্ত্রণে রেখে দিয়েছেন ।
অখিল, মা’ নামক আমার দেশটার খবর কী ? সেই ৭১ এর দিনগুলো কী আজো তোমাকে অবিরাম তাড়িয়ে বেড়ায় ? যুদ্ধকালীন ০৯ মাস আমরা এক বিছানায় ঘুমিয়েছিলাম, পাকিস্তানি দানবদের কী ভয়ঙ্কর অত্যাচার, কে কোন জাতের’ তা তারা বিচার করত লুঙ্গি-পায়জামা খোলার ধৃষ্টতা দেখিয়ে এবং সেই অনুসারে শাস্তি নির্ধারণ করত, কতটা পাষণ্ড হলে এমনটা করা যায় !!
যুদ্ধরত অবস্থায় রাজাকার বাহিনী আমার বড় দিদিকে আমাদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে তুলে দিলো । আমার সেই দিদিটা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তা আমি আজও জানি না । যে রাজাকারের বাহিনী আমার দিদিকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল– বেশ কয়েক বছর পূর্বে তাকে ক্যালিফোর্নিয়াতে একটা অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম, আমদের দেশের দামাল ছেলেরা, যাদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে, দেখলাম সেই রাজাকারকে তারা পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে । ওইখানে অনেক পুলিশ থাকায় আমার করার তেমন কিছুই ছিল না; বিড়বিড় করে হয়ত কারো কাছে আমি অভিশাপ দিয়েছি মাত্র।
বন্ধু , যতটুকু পারো মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের বোধ ও ইতিহাস কিছু উঠন্ত দামালের সঙ্গে ভাগাভাগি করে যেও । যে বোধের দায়বদ্ধতায় আমরা যুদ্ধ করেছি, সেই বোধসমূহ কে কাঁচা-নবীনের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া যে আমাদের আর একটা যুদ্ধ, আর একটা পবিত্র দায়িত্ব ।
অখিল, তুমি তো জানো, শারমিনের সাথে আমার তুঁই-তুঁই সম্পর্ক ছিল । ও সারাদিন আমাকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকত । আমার সব, আমার সব কিছু ও’ নিয়ন্ত্রণ করত। আমার নাওয়া- খাওয়া, ঘুম, কোন জামার সাথে কোন প্যান্ট, কোন স্যান্ডেল, কোন জুতো–সব ও দেখভাল করত। ও যদি পারত–ওর কবরের মাঝখানে আমাকেও রেখে দিত কিন্তু আমার মতো হায়না দিয়ে কী আর সেই কাজ করানো সম্ভব?
মাঝে মাঝেই, ও আমাকে বলত, আমি না থাকলে তুঁই বুঝবি ! শারমিন, আমার শারমিন, তুঁই তোঁর জীবন দিয়ে তোঁর না থাকার মানেটা আমাকে বুঝিয়ে গেলি । লিখতে পারলে আরো দুচারটা লাইন আমি লিখতাম, বন্ধু কিন্তু চোখের জল শুকিয়ে যাওয়ার কারণে আর আমি পারছি না ভাই , নশ্বর এই রঙ্গমঞ্চে যতটা ভালো থাকা যায় তুমি ততটাই ভালো থেকো ।
তোমার শ্রীকান্ত