প্রিয় খোকা | মুহাম্মাদ ইমরান | Prio Khoka | Muhammad Imran |

আশ্রম থেকে বাবার খোলা চিঠি

প্রিয় খোকা

ইদানীং স্মৃতিগুলো বড্ড বেশি বেয়াড়া হয়ে গেছে । তারা রীতিমত প্রতারণায় মত্ত । স্মৃতি হাতড়ে বহুদূর চলে যাই তারপরও তোকে খুঁজে পাই না । বয়সের ভারে অনেক স্মৃতিই এখন ধূসর কোনো কাব্যিক সংস্করণ । বাজান’ তোর মনে আছে, ছোটবেলায় তোর বুক আমার বুকের সাথে না মিশালে তোর ঘুম আসত না ।

প্রায়ই তুই মাঝরাতে জেগে উঠতি । আমি সারারাত কত সব অদ্ভুত গল্প শুনাতাম । জানিস বাবা, আমার এখনও সব গল্প দিব্যি মনে আছে; একই ধরনের কাহিনী বারবার বলাতে’ বোধ হয় আÍস্থ হয়ে গিয়েছিল । মনে আছে বাবা, মেট্রিক পরীক্ষার সময় তোর একবার কালাজ্বর হয়েছিল ।পীর বাবার কাছে তোর নিথর দেহখানি নিয়ে গিয়েছিলাম; হুজুরকে আমি ডাক দিয়ে বললাম, প্রভুর কাছে আপনি একটু দোয়া করেন যেন আমার বদলে আমার বাজান বেঁচে থাকে ।

বৌমা, দাদু ভাইয়েরা কেমন আছে ? বৌমাকে তুই ভুল বুঝিস না । সে তো আমাদের রক্তের কেউ না । আমার জন্য চিন্তা করিস না । এই আশ্রমে আমি বেশ ভালো আছি । আমরা সব দিয়ে জনা পঞ্চাশেক বাবা আছি এখানে । এদের মধ্যে আমি বোধ হয় মানসিক দিক দিয়ে একটু ঢের অবস্থানে আছি; ওই হতভাগারা বেশির ভাগই ছেলে বা ছেলের বউর হাতের চড়-থাপ্পড়, লাথিগুতা খেয়ে এই আশ্রমে পাড়ি জমিয়েছে, সেই দিক দিয়ে আমি তোর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ ! আমার  সে রকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি, বোধ হয় ।

তুই যখন আমাকে আশ্রমে দিয়ে গেলি, আমি কিন্তু খুব স্বাভাবিক ছিলাম । আমি তোকে এত বেশি  ভালোবাসি যে তোর আশ্রমে দেওয়াটাকেই আমার কাছে অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে । বাজান আমি জানি, আমার জন্য তোরও খারাপ লাগে; না বাবা’ মন খারাপ করিস না । আশ্রমে দেওয়া ছাড়া তোর আর কী-ই বা করার ছিল ?

জানি না কী হয়েছে, ইদানীং প্রায়ই তোর মাকে স্বপ্ন দেখি । কী কারণে যেন মৃত্যুকেই আমার সবচাইতে আপন মনে হয় । মনে হয়, মৃত্যুই হতে পারে আমার সাঁঝের মায়া । মৃত্যুই কেবল পারে পৃথিবীর দুর্গন্ধময় বাড়তি এই উপদ্রবকে থমকে দিতে ।

আমি মারা যাওয়ার পর তোর বেশ কিছু পয়সা খরচ হবে । দাফন-কাফন, মিলাদ, চলি­শা আরও কত কি ? অহেতুক টাকা খরচ করার জন্য বৌমা বোধ হয় তোকে অনেক বকবে । বাজান তুই ভালো থাকিস । তুই  বড় হয়ে যাওয়ার কারণে তোকে জড়িয়ে ধরে বহুকাল চুমু খাওয়া হয় না । আমার মৃত্যুর পর পারলে তুই সেই কাজটি করিস

                                                                            ইতি—               

তোর হতভাগ্য পিতা

হাসু আপা | মুহাম্মাদ ইমরান | Hasu Apa | Muhammad Imran |

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বায়েজিদের কাছে লিখা হাসু আপার ব্যথার কাজলে মাখা একটি চিঠি ।

প্রিয় বায়েজিদ

সংসার নামক এক অদ্ভুত ধর্ম পালন করিতেছি প্রায় বছর সাতেক । তবে সত্য কথাটা হইলো এখনো আমি তোমার বাহিরে তেমন কিছুই ভাবিতে পারি না । জানি এটা অন্যায় তারপরও এটাই আমার কাছে ন্যায় । কোনোরকম কারণ ছাড়াই মানুষ বড় বেশি স্বার্থপর । মানুষ সবচাইতে ভালোবাসে তার নিজেকে আর আমার নিজ বলিতে কিছুই নাই । তোমার আর আমার মাঝে ফাঁক খোঁজাটা মৃত্যুর পরেও আমার দ্বারা সম্ভব নয়; সেই সুখানুভূতির মায়াবী ছলনাটুকু বেশ ভালোভাবেই আঁকড়াইয়া ধরিয়া আছি, যাহার কারণে এখনো দিব্যি বাঁচিয়া রহিয়াছি ।

তুমি জানো কি না জানি না, ইতিমধ্যে আমার একটা বাচ্চা হইয়াছে । আমার স্বামীটাও বেশ । মনে হয়, অনেকের চাইতেই ভালো আছি তারপরও নিজেকে কেমন যেন রোবটের মতো লাগে । মনে হয় যান্ত্রিক এই সভ্যতায় আমি নিজেও পুরোদস্তুর যন্ত্র হইয়া গিয়াছি ।

খুব সকালে ঘুম হইতে উঠিতে হয় । বাচ্চাটাকে স্কুলে লইয়া যাই । অতঃপর ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্কুলের করিডরে বসিয়া থাকি। যদিও আমি একা নই, আমরা সব মা’ই বসিয়া থাকি । আশ্চর্যজনক বিষয়টা হইলো, প্রত্যেকটা মহিলাই শুধু নিজেদের কথাই বক বক করিয়া বলিতে থাকে । কাহারও কথা কাহারও শোনার বিন্দুমাত্র সময় নাই ।

আমার স্বামী বেশ রাত করিয়া বাড়ি ফিরে । আমরা একই ছাদের নিচে থাকিলেও ভাবখানা এমন যেন কেউ কাউকে চিনে না । যদিও এর জন্য আমিই  ঢের দায়ী। আমরা যে যার মতো ব্যস্ত ।  রুটিনমাফিক এই জীবনে আমি ক্লান্ত এক পথিক’ আপাতত খেই হারাইয়া ফেলিয়াছি । দিন যাচ্ছে আর আমিত্বর কাছে ক্রমশ হারাইয়া যাইতেছি ।

তোমার প্রতি তেমন কোনো অনুযোগ আমার নাই । তোমাকে আমি যখন বলিয়াছিলাম, বাবা আমার জন্য ছেলে খুঁজিতেছে, তাড়াতাড়ি কিছু একটা করো । তোমাকে না পাইলে আমার বাঁচিয়া থাকা মুশকিল হইবে । সেই সময়টায় রাজ্যের সব অসহায়ত্ব কেন তোমাকে গ্রাস করিয়াছিল তাহা বোধ করি আজ অবধি আমার অজানা ।

মাঝে মাঝে তুমি এমন করিতে যেন তোমার রক্তের মধ্যে আমার নিঃশ্বাসের ফোয়ারা বহিতেছে । তুমি কী সেইটা সত্যি সত্যি করিতে নাকি অভিনয় করিতে তাহা আমি জানি না । আমি আমার আবেগ তোমার মতোন করিয়া প্রকাশ করিতে পারিতাম না; এর একটা কারণ আমি নারী আর একটা বোধ হয়, তোমার প্রতি অতিশয় আসক্তি যার প্রলয়ঙ্করী প্রভাব আমাকে নির্বাক, নিথর, নিস্তব্ধ করিয়া দিয়াছিল।

এখনো তোমার অনেক স্মৃতি আমাকে আহ্লাদিত করিয়া চলিয়াছে । প্রায় প্রত্যেক রাতেই তুমি আমার চোখের নোনাজলে হারাইয়া যাও । আমি সব জানি। তুমি ভালো মানুষ নও । আমি জানি,  আমার স্বামী প্রতারণার ফাঁদে আটকা পড়িয়াছে । তুমি আমার দুর্বলতাকে উপহাস করিও না । মোটেও ভাবিয়ো-না  আমি পাগল হইয়া গিয়াছি ? আমি নিজেকে অনেক ভালোবাসি, তাই তোমাকে ভালোবাসি এবং বাসবো ।

ইতি—

তোমার  হাসু