চার দেয়ালের নীল | মুহাম্মাদ ইমরান | কালোত্তীর্ণ চিরকুট |

0 Votes

সর্বান্তকরণ আবেগের মাঝেই অবুঝ প্রেমের বসবাস , আবেগকে প্রশমিত করে ভালোবাসার ঝাণ্ডা তুলে ধরা মোটেও সহজসাধ্য নয় ,  ভালোবাসার অনন্যসাধারণ বোধসমূহের যথার্থ মূল্যায়ন করেই যে  বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানো যায়- তারই যথার্থতার প্রকাশ – জেলখানার কয়েদি মেহেদী হাসান নীলের কাছে লিখা – ইসরাত জাহান আশার একখানা জীবনবাদী পত্র ।

নীল

দুর্নিবার কোন আকর্ষণ- আমার স্বাভাবিকতায় অথবা স্বপ্নিল আরাধনায় হানা দিতে পেরেছে কি না- মনে পড়ে না , অঝরে কারো জন্য একাকী কেঁদেছি নাকি – তাও বলা মুশকিল । কারো প্রতি অতিশয় আসক্তির চেতনা আমাকে কখনো শাসন করতে পেরেছে কি না তাও বোধ করি আমিই জানি না । সোজা কোথায় তোমার প্রতি সামান্যতম আনুগত্য কোন কালেই আমার ছিল না তবে আমাকে পাওয়ার জন্য তোমার অমানুষিক পরিশ্রম- আমার হৃদয় গহীনে যে একেবারে দাগ কাটেনি তাও বলা যাবে না ।

কিন্তু সেই হাড়ভাঙ্গা শ্রমের বিনিময়ে তুমি আমার কাছ থেকে যা নিয়েছ তাকে আর যাই হোক ভালোবাসা বলা যাবে না- একজন নাছোড়বান্দা ভিখারি কে ভিক্ষা দেওয়া অথবা শ্রমের বিপরীতে পারিশ্রমিকের নামে  করুণাদেওয়া’  বলাই ঢের শ্রেয়। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করি , নিয়মের দেওয়ালগুলো কখনোই আমার কাছে অনিয়ম হতে পারেনি । আমি যখন মায়ের সাথে শিল্পকলায় গান শিখতে যেতাম, তুমি বিনা কারণেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাকে এক নজর দেখার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে , বিশ্বাস করো একটি দিনও আমি ভাবিনি ওই মানুষটা কেন আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে ?

আমাদের বাড়ির সামনের আম গাছটায় তাবিজ ঝুলানো দেখতাম , ওই দেখা পর্যন্তই , আমি বুঝতাম কিন্তু তাবিজ’ কে রেখেছে তা নিয়ে কোনো বিশেষ ঝোঁক আমার হৃদয়ের চিলেকোঠায় পরিলক্ষিত হয়নি । নারকেল গাছ বেয়ে তুমি রাত- বিরাতে আমাদের চালের উপর বসে থাকতে- শুধু আমাকে এক নজর দেখার জন্য ,চালের উপর ঘুমিয়ে থাকার জন্য একদিন আমাদের বাড়ীর লোকজন তোমাকে অনেক মারধর করল, পরে জানা গেলো অনেকগুলো ঘুমের বড়ি খাওয়ার জন্য তুমি আনমনে চালের উপরই তন্দ্রার ঘোরে হারিয়ে গিয়েছিলে, বেধড়ক পেটানোর জন্য তোমার বাম হাতটা ভেঙ্গে গিয়েছিল এবং তুমি সেই ভাঙ্গা হাতের ব্যান্ডেজ পরিহিত অবস্থায় আমার সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করতে – উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার কিন্তু আমি আরও বিরক্ত , ওই মুহূর্তে করুণা তো দূরের কাব্য – এক ফালি ঘৃণিত বোধের সঞ্চারণও তুমি করতে পারোনি  ।

আমার সুশৃঙ্খল জীবনটা অতিষ্ঠ করে দিয়েছিলে তুমি । কলেজের সামনে একদিন আমাকে তুমি কি যেন কী বলতে চাইলে, আমি দৌড়ের মত করে হাঁটতে শুরু করলাম , আমার মা অনেক বন্ধুদের সামনে তোমার গালে কসে থাপ্পড় মারল , তোমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল , তুমি কোনো  কথা বলোনি তবে তোমার অশ্রুর অন্তর্যামী ভাষা বুঝে নিতে আমার দেরি হয়নি ।এই প্রথম তোমার বিষয়টা আমাকে খানিকটা স্পর্শ করল , তোমার আবেগ, পুঞ্জিভূত কিছু অভিমান এবং অভিযোগের অশ্রু আমাকে বিচলিত করতে সক্ষম হলো , তবে তোমার সেই বাধভাঙ্গা চোখের জল- আমার করুণার দেওয়াল টপকাতে পারেনি ।

এভাবেই চলছিল আমাদের দিনকাল , ইতিমধ্যে তুমি বেশ কয়েকবার মেট্রিক পরীক্ষায় ফেল করলে আর আমি গোল্ডেন এ প্লাস সহ ইন্টারমিডিয়েট শেষ করলাম সুতারং দিন কে দিন পরিস্থিতি তোমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে লাগল । কলেজেপড়া অবস্থায় মাসুদ রানা নামক একটা বাবুগোছের ছেলের সাথে আমার যৎসামান্য সম্পর্ক হয়েছিল , সত্যি কথা বলতে কী এই সম্পর্কের ব্যাপারটায় মাসুদের তেমন কোন ভূমিকা ছিল না উপরন্তু আমিই তাঁকে অনেকটা জোরপূর্বক রাজি করিয়েছি , আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছ , না নীল- কষ্ট পাওয়ার তেমন কিছু নেই , এটাই ঢের বাস্তবতা এবং ধ্রুব সত্য ।

মানুষ তাঁর নিজের ইচ্ছাতে প্রেমে পড়তে পারে না , এটা আনমনে ,বেখেয়ালে অথবা হেয়ালির ছলে একাকী হয়ে যায় , সমস্ত নিয়মের বলয় ভেঙ্গে অপরিপক্ক বোধসমূহের ছোট ছোট কিছু ভুলের মাঝেই এই প্রেমের বসবাস, এটি হতে পারে একটা মানুষের সর্বোত্তম আবেগের এবং সর্বান্তকরণ ক্ষমার অদ্ভুত এক বহিঃপ্রকাশ । প্রেম কেমনে হয় , কে করায় , কে মধ্যস্থতা করে , কে এর লাটাই ঘুরায় তা জানার সময় কই বরং তাঁর মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকার প্রশান্তি নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকতে পারে অনাদিকাল অথবা মরে যেতেও যেন তাঁর কোনো  বাঁধা নেই ।

খুব সহজ করে বলতে গেলে, আমাকে তোমার কেন ভালো লেগেছে তা যেমন তুমি জানো না , ঠিক মাসুদ রানাকে ভালো লাগার কোন যৌক্তিক কারণ আমার কাছে আপাতত নেই , তবে মাসুদের প্রতি আমার দুর্বলতার প্রকাশ একেবারেই সামান্য , সে মোটেও আমার চিন্তার ধারাপাতে কোনো  প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি , তাকে আমার ভালো লাগত , কেবল এতটুকুই । যখন শুনলাম মাসুদ বিবাহিত – আমার মনটা একটু খারাপ হলো কিন্তু আমি তাকে প্রতারক ভাবিনি কারণ দোষটা আমারই । আমার সাথে স্পষ্ট করে তুমি কথা বলতে পারতে না , তোতলাতে আর যা বলতে তাকি ফ্রেঞ্চ নাকি হিব্রু তা নিয়ে আমি সন্দিহান থাকতাম অথচ আমি শুনেছি তুমি নাকি চমৎকার গান করো এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নান্দনিক উপস্থাপনা করো।

সেই তুমি বেশ সাবলীলভাবে একদিন আমাকে ফোন করে জানিয়ে দিলে তুমি আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চাও , আমি তোমাকে মোটেও ভালবাসতাম না এটা সত্য কিন্তু বিশ্বাস করো আমি বোধ হয় তোমার ওই প্রস্তাবটার জন্যই বসে ছিলাম কারণ আমি এটা বুঝতাম, আমার তাকেই বিয়ে করা উচিৎ যে আমাকে ভালোবাসে । যাই হোক, আমি বীরাঙ্গনা বেশে তোমার হাত ধরে পালিয়ে গেলাম , আমরা বোধ হয় এক মাস একসাথে ছিলাম , তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো- সন্দেহাতীতভাবে তা প্রমাণিত।

কিন্তু ভালোবাসাই যে সর্বশেষ কথা নয় এবং এটি আবেগের চাদরে মোড়ানো কয়েকটি বর্ণ মাত্র , এই প্রথম শরীর এবং হৃদয়ের দামে আমি তা বুঝে নিলাম । একটি টাকাও তোমার কাছে নেই ,ভরসা কেবল চুরি করে আনা আমার মায়ের গহনা সকল । তোমার সাথে আমার কিছুই মিলছে না , আমি পরিপাটি , মার্জিত বোধের দাস আর তুমি অগোছালো , নোংরা, মাদকাসক্ত, গালি ছাড়া কথা বলতে পারো না – কেমন যেন বস্তির উদ্বাস্তু জীবনের চিত্র তোমার মধ্যে বহমান , আমি বড় বিপদে পড়ে গেলাম ।

ইতিমধ্যে আমার বাবা- মা’ পাগলের মতো  আমাকে খুঁজে- ফিরছে , তোমার নামে গোটা দশেক মামলা রুজু করা হলো  , আমার বাবা অনেক প্রভাবশালী এবং শিল্পপতি হওয়ায় তুমি খুব ভয় পেতে , পুলিশ তোমাকে ধরে নিয়ে গেলো  এবং তারপর থেকে তুমি এখন অবধি জেলেই আছ  । তোমার হতদরিদ্র বাবা- মার সাথে আমার কথা হয় , তারা তোমার জামিন করানোর জন্য আমার কাছে অনেকবার এসেছে ,আমি ও বিরামহীন চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা । আমার বাবা – মার সাথে এখন আমার কোন সম্পর্ক নেই , প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করছি , উপরের ঠিকানায় আছি ।

না, আমি তোমার কাছে আর ফিরে যাব না এবং আমি তোমাকে একতরফাও দিয়ে দিয়েছি । নীল- শুধু ভালবাসা আর আবেগের মূর্ছনা দিয়ে সংসারের বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়াটা কঠিন , তবে তুমি আমার জন্য সারাজীবন যে অমানুষিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছ তা ভেবে আমি কষ্ট পাই । কি না করেছ  তুমি আমার জন্য ? আমি তোমাকে ভালবাসতে পারিনি সত্য কিন্তু তারপরও তোমাকে আমার লক্ষ্মী, সোনা, মানিক বলতে ইচ্ছা করছে, তোমার এতিম, অবুঝ ভালবাসাকে প্রণাম না জানালে যে – ভালবাসাকেই অপমান করা হবে । আমি বাস্তববাদী তবে ভুলের ঊর্ধ্বের কেউ নয় , আশা করি আমাকে ক্ষমা করবে , নিঃশর্ত ক্ষমা !

তোমার আশা


মুহাম্মাদ ইমরান

২৩ ০১ ১৬

ছড়িয়ে দিন ইচ্ছেমত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *