মহাকালের সাক্ষী এক কবিতা | নিমাইর লকডাউন | মুহাম্মাদ ইমরান | Nimair Lockdown | Poet Muhammad Imran

সুদখোরদের মতো
নিমাইর গচ্ছিত কোনও টাকা নেই ।
কাম করলে খায়, কাম না করলে–?
১ বউ, ০২ কন্যা আর বুড়ো মাকে নিয়ে
ওরা মোট ০৫ পেট ।
০৫ পেটের কামাইছুত নিমাই একাই ।

বছর কুড়ি আগে
আলীপুর মোড়ে নিমাই তাবিজ বেচত ।
আয়-রোজগার তখন মন্দ ছিল না
ঠাকুরের দোকান থেকে মায়ের জন্য
রসগোল্লাও আনা হতো অকস্মাৎ ।
তাবিজের চল উঠে যাওয়ায়
নিমাই বছর কয়েক মাটি কেটেছে ।
কয়েক-বসন্ত রাজমিস্ত্রির জোগালদারও ছিল ।

এতিম নিমাইর’ জগাই নামে এক ভাই ছিল
৭১ পরবর্তী সময়ে
রক্ষীবাহিনীর হাতে ভিটেমাটিসহ
জগাইকেও জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে ।

নিমাইর বড় মেয়ে ইলিশে মন্ত্রমুগ্ধ
মাছবাজারের চারিপাশে
নিমাই চোরের মতো ঘুরে ।
ইলিশের দর আর নিমাইর লুঙ্গির গোঁজ
ভবেরহাটের দুই মেরুর অবস্থান ।

এখন নিমাই অটোভ্যান চালায়
মহাজনের জমা দেওয়ার পরও
৩০০/৫০০ থাকে ।
ভালো খেতে না পারলেও
০৫ পেট চলে যায় ।
চলে যেতে হয় ।

করোনা বা লকডাউনের
জুতসই কোনও সংজ্ঞা–
নিমাইর জানা নেই ।
বোধ হওয়ার পর থেকে নিমাইর একটাই মন্ত্র–
কামলা দিতে পারলে ০৫ পেট চলবে
নয়-তো ?

নিমাই কী ভ্যান চালায় না পেট চালায়
তা ওর ভোঁতা মীমাংসায় ছোঁয় না ।
লকডাউনকালে নিমাই ১০০০ টাকা করে
অদ্যাবধি ০৩ বার জরিমানা গুনেছে।
নিমাই ক্ষীণ এবং হীন সুরে ম্যাজিস্ট্রেটকে
অত্যল্প বোঝাতে চেষ্টা করেছে–
করোনা, লকডাউন, মাস্ক , ঘরে থাকা,
হাত ধোয়া, গাও ধোয়া—
সবই অধম মেনে নিবে
শুধু আমার ০৫ পেট ভরে দেবার নিশ্চয়তা দেন।
ফলাফলঃ পুলিশের চড়-থাপ্পড় ,পাবলিকের ট্যাক্সের
টাকায় কেনা সরকারি বুটের পাইকারি লাথি
এবং ম্যাজিস্ট্রেটের দস্তখতসহ
১০০০ টাকার জরিমানার স্লিপ ।

হরিপদ নামে নিমাইর এক স্কুল-মাস্টার বন্ধু আছে ।
হরিপদ নিমাইকে বলেছে —
বিদেশে লকডাউনের সময়
সরকার ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেয় ।
নিমাইর সরল কোরাস–
গতর থাকতে পরেরটা আমার লাগবে না
কিন্তু সরকার উল্টো ৩০০০/= নিয়ে নিলো, কেন ?

০১ জুলাই থেকে তীব্র লকডাউন চলছে
দেখা মাত্রই গ্রেফতার!
গ্রেফতারের ডর
নিমাই-অবধি পৌঁছানোর সুযোগ নেই ।

ভাবলেশহীন নিমাই
ভ্যান নিয়ে বের হয়ে পড়েছে,
চুরি-চামারি করে
যদি দু-এক খ্যাপ মারা যায় ?
কিন্তু আজ আর তা হলো না

পুলিশ এবং আর্মির যৌথ অভিযানে
নিমাইকে আটক করা হলো ।
একই অপরাধ বারবার করায়
নিমাইকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট
০৬ মাসের জেল দিয়ে দিলো ।

নিমাইর চোখেমুখে আন্ধার ।
০৬ মাস না
আমাকে ৬০ বছরের জেল দেন।
আমি না আসা পর্যন্ত
শুধু আমার বাড়ির ০৪ পেট
ভরার ব্যবস্থা করে দেন ।
পুলিশ আর বসে থাকতে পারল না ?
স্যারের সাথে বেয়াদবি ! মুখে মুখে তর্ক !
বানচোদ, শালা মালাউনের বাচ্চা
বলতে বলতে এবং সমানে লাথি মারতে মারতে
নিমাইকে গাড়িতে উঠিয়ে ফেললেন ।
নিমাইর অশ্রুকবলিত দুটি চোখে হরেক প্রশ্ন ?
না-বলা অভিমানের স্তূপ ?

কমিশনার,ম্যাজিস্ট্রেট, মেয়র ,ডিসি, সচিব,
চিত্তশালী, বিত্তশালী, রক্ষণশীল, প্রগতিশীল,
সুশীল, মোড়ল, কামলা, মাদবার, মৃদুভাষী,
স্পষ্টভাষী, মন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী
এবং লিঙগহীন আন্দোলনপ্রিয় জনগণ–
সবার কাছে নিমাইর অব্যক্ত আবেগের
দ্ব্যর্থহীন এবং শর্তহীন প্রশ্ন–
আমার অবর্তমানে
আমার ০৪টি পেটের দায়িত্ব নিবে কে ?

মুহাম্মাদ ইমরান
০৪ ০৭ ২১

অশ্রু দিয়ে নির্মিত কবিতা || আবার আমি পাই যদি তাঁরে ? কবি মুহাম্মাদ ইমরান || Poet Muhammad Imran

সেই আটটি বছর আগে
হারিয়ে ফেলেছি যারে
চলছে দায়মোচন , অভিশাপ
আর অশ্রুর নীরব সাতকাহন ।

নিদ্রায় যাওয়ার আগে
রুটিন করেই ভেবে রাখি,
সকাল হতেই আসিত যদি ফিরি,
আসিত যদি কলজের-টুকরা মানিক আমার
মোর শ্মশানপুরের গেহখানি জুড়ি।

অথবা বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেত
সোনালী সোনালী আকাঙ্খার চারণভূমি
কৃষাণের অনিন্দ্যসুন্দর স্বপ্নের
আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে
আবার আমি পাই যদি তাঁরে ।

অথবা ব্যস্ততার এক নীরস দুপুরে
দস্যুপনা গিয়েছে হারিয়ে
উদাসী বনের ধারে,
নির্বাক, নির্লিপ্ত, অসহায় আমি
গোধূলির বিষণ্ণতায়
মিলিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ব্রত —

হঠাৎ করেই পেছন থেকে ঝাপটে ধরে
আমায় যদি বলে–
শরীরের এ কী হালকরেছ তুমি ,
নাওয়া-খাওয়া হয়নি ক’দিন ধরে ?

কেতাদুরস্ত ভড়কে যেয়ে
আমায় যদি বলে – কী করেছ তুমি !
কী করেছ মানিক আমার,
চোখের নিচে কালি কেন,
ঘুমাও না’ ঠিক মতো ?
চুলগুলো এলোমেলো কেন,
পায়ের নখ বড় কেন,
ঘামের গন্ধ আসছে কেন,
করবোটা কী আমি তোমারে,
এই ছিল আমার কপালে !

এত শত অধিকার যার,
কোথায় পাই, তাঁরে আমি আবার ?
একি আবোল-তাবোল লিখে চলেছি
না কি অন্ধকার এক ঘোরে
বুঁদ হয়ে আছি !

আচ্ছা, পা হতে মাথা অব্দি
নেই কোথা সে ?
দৃশ্যত সে কাছে নেই
তাতে হয়েছেটা কী ?
আমা থেকে তাঁকে বাদ দিলে
আমাতে আর থাকেটা কী ?

মুহাম্মাদ ইমরান
২৮ ৫ ২০১৫

মুহাম্মাদ ইমরানের কবিতা || জান ||

কাল আচমকাই মধ্যরাতে তুঁই হানা দিলি
তোর মিষ্টি গন্ধটা অনুভব করছিলাম
কেমন যেন তোঁর নিঃশ্বাসের ফিসফিসানি
আমার পুরো কলিজাটা জুড়ে বয়ে বেড়াচ্ছিল ।

শুনলাম তুঁই সুখে আছোস
তোঁর সুখে থাকাটা আমার স্পন্দন
সচল রাখার জন্য কতটা জরুরি
তা তুঁই ভাল করেই জানোস !

আমার জন্য ভাবিস না
তোঁর নিঃশ্বাসের গন্ধটা
আমি আমার বিশ্বাসের মধ্যে’
অনেক শক্ত করে পুঁতে রেখেছি ,
আশা করি,
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভালোই থাকবো ?

ইতি –
তোঁর জান’

মুহাম্মাদ ইমরান
২০০৩, ঝিলটুলি, ফরিদপুর

মার কথা মনে পড়ে ? মা কেন এমন ? মুহাম্মাদ ইমরানের কবিতা || Poet Muhammad Imran

কী-রে একি তামাশা আজব
জ্বর হয় আমার
চেয়ে দেখি
আমার চেয়ে বেশি জ্বর মার ।
ঘুম নেই মার চোখে
একটু পরপরই তার
বাজানের মাথায় হাত রেখে
কী যেন কী দেখে ?

পরীক্ষায় ফাস্ট হলাম আমি
খেলায়ও জিতলাম আমি
অথচ ফাস্ট হলো মা
কই জিতলাম আমি
জিতলও যেন মা ।

মেলে না উত্তর
ভাবি বসে নিরালা–
চারপাশে চালাকদের বুদ্ধি ফাঁদা
দিগন্ত জুড়ে মানুষ-বেশে
জানোয়ারের গাঁদা ।
এত ছ্যাঁচড়ের ভিড়ে
কোন সে কারিকর
এমন মা দিলো পরান ভরে ।

ওহ্‌ পেয়েছি পেয়েছি’
মা-তো আলাদা কিছু নয়
অভিন্ন আত্মা, একই সত্তা
নাড়িটাও যে ছিলো এক
কোথা থেকে ধাত্রীবেটি এসে
দিয়ে গেলো করে ফারাক ।

বসে খাবার টেবিলে
মুরগির রান আর
মাছের মাথা খাই সমানতালে;
মার হাসিতে বিরল মুগ্ধতা
মাথা খাই আমি , মা খাচ্ছে মমতা ।

যদি বলি
রুই মাছের মাথাটা
আজকে কী খাওয়া যায় না , মা ?
মার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে
ভাবটা এমন, সে খেলে
পৃথিবী ধ্বংসও হতে পারে ।
খেয়েছি , পরে খাব, আর একদিন খাব
অথবা এমন কথা বলে না বাপ–
সারাবছর সব মার-ই একই উত্তর ।
এভাবেই চলছে জনম দুঃখিনীর আয়ুষ্কাল
এভাবেই চলছে মা-দের দিনকাল ।

চুপটি মেরে ভাবি বসে একেলা
মা কেন এমন ?
এমন স্বার্থ উদ্ধারের মিছিলে
এই ভদ্র মহিলাকে
কে পাঠালো , এই চির অভাগার তরে ?

মুহাম্মাদ ইমরান
২৫ ৬ ১৮