মা’ কীসের তফাত তোর আর দ্যাশে ? তফাত শুধু মুখের বুলি পাই না তো অনুভবে ।
বল, মা’ তফাত কোথায় জন্মে না বেড়ে ওঠায় ? তোরে ডাকি মা, তাঁরে পারি না। সে আছে জড়ায়ে চেতনার গন্ধে বিশ্বাসের তোপে, মেঠোপথ খুঁড়ে আছে তাড়িত আবেগের সকল রন্ধ্রে ।
মারে’ তুই বিভাজন করিস না তুই ডাক দেস বাজান সে-তো পারে না । সে আছে রক্তকণিকায় লাল সবুজের পিঞ্জরায় গহীন পরান ভরিয়া; আছে অস্তিত্বের দ্রোহে শীতল চক্ষু জুড়িয়া ।
তাঁকে ঘিরেই ছবি আঁকি তাঁর মাঝেই বেড়ে উঠি। আশাহত হলে সে ভরসার পাল তুলে দেয় সপ্নের চাষ সেও যে আমার মা। অদেখা, রঞ্জিত আবেগের অশরীরী মা। তাঁর শুধায় শোধিত হয়েই তোরে ডাকি মা খবরদার খবরদার বারণ করিস না ।
লক্ষ্মী মা আমার, অমন করিস না সব বোধের বহিঃপ্রকাশ থাকে না সব ভালো লাগা ব্যক্ত করা যায় না সব ভালোবাসা বোঝানো যায় না সব শান্তির আদ্যোপান্ত খুঁজতে হয় না সব অনুভূতির প্রকাশ সার্থক হয় না সব চোখের পানি নিলামে উঠে না সব প্রেম প্রেমজ্বরে আক্রান্ত হয় না সব প্রেম প্রেমবাজারে বিক্রি হয় না ।।
অনেক হয়েছে। এবার মুক্তি দাও। অনেক সয়েছি। এবার ছেড়ে দাও । হুম, আমি জানি আমি ভুল করেছি। ভুল অমানুষকে ভালোবেসে ভুল আত্মাকে কাছে টেনে ।
না না’ আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার কখনো কেউ ছিল না এখনো কেউ নেই । তোমাদের এই রঙ্গমঞ্চের আলাদা একটা ভাষা আছে তোমাদের যাপিত সমাজ ব্যবস্থার অভিন্ন একটা রূপ আছে ।
রূপটা স্বার্থের তাগাদা পূরণের হাসিমুখে অনর্গল মিথ্যা বলার গরীবের পয়সা চুষে নেওয়ার নিশিদিন ভালো মানুষের অভিনয় করার ।
তোমাদের চরিত্রের বাইরে আরও একটি চরিত্র বিদ্যমান; কাম তার নাম অথবা যৌনতা শাড়ির মাঝে হাঁ করে তাকিয়ে থাকার স্বতঃস্ফূর্ত প্রবণতা নচেৎ মদ্যপান ।
মানতে কোন বাধা নেই, তোমরা যোদ্ধাজাতি তোমরা বীর, বীর মুক্তিযোদ্ধা । জীবন্মৃত সব বাঙলা প্রাণীর হুঙ্কার তোমরা ১৬ কোটি বাঙালির দম্ভোক্তি আত্মিক প্রশান্তি, চূড়ান্ত অহঙ্কার ।
আবার তোমরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও মাসিক ভাতা খাও তাকবিরুল্লাহর সহিত ০৫ ওয়াক্ত নামাজও পড়ো কথায় কথায় ৭১ এ ফিরে যাও ।
মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও হয়েছ তুমি আগুয়ান হানাদার ধ্বংস করতে তুমি পিছপা হওনি মোটেও অকুতভয় জাওয়ান । রাইফেল বইবার ক্ষত এখনও তোমার কাঁধে অক্ষত ।
বানিয়ে বানিয়ে কী সুন্দর গল্প সাজাও দাদীমার রূপকথার ঝুলিকেও হার মানাও । বাটপারও তোমার কাছে মেনেছে হার ৩০% কোটা ছাড়া কী হতো না তোমার ? ওহে ভণ্ড, গর্বিত জানোয়ার কোন ভূষণে সাজবে তুমি কোন কাফনে বাঁধবে তুমি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, বীর কুলাঙ্গার ।
ও’ দুবাই ফেরত কম্বলওয়ালা ! দেখা হয়েছি কী কখনো চাঁদের নিচে লুকানো টার্মিনালে কুচিমুচি হয়ে শুয়ে থাকা বুড়ির’ থর থর কাঁপন দেখা হয়নি বুঝি, টুকাই আর কুকুরের গলাগলি ধরি, অভিশাপের রাত শেষ না হওয়ার রাত্রি যাপন ।
পার্থক্য কোথায় জানতে চাই তাঁরা কী তোমাদের থেকে আলাদা কিছু ভাই । হুম ! তাঁরাও মানুষ তবে শুধু দেখতে সাহিত্যিকের ভাবনা জুড়ে পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা ভরে কোটিপতির ০৬ তলার পরে দৃষ্টিকটু একটি ছোট ছোনের ঘরের তরে ।
অনেক তো হলো এবার দাও যেতে এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে কেবলই নিজকে নিয়ে পড়ে থাকার কলেবরে কী চাও অভাগার দল খামাখা দৃষ্টি জুড়ে তোমাদের টিআর, রিলিফের চাল আর কাবিখা ।
তোমাদের কী অসুখ করে না, তোমরা কী মৃত্যুহীন প্রাণ ? রোজ হাশরের ময়দানে দাঁড়াবে না তুমি, সন্মুখ রহমান ?
ইদানীং মৃত্যুকে নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ । যদিও জীবনবাদী ও সুবিধাবাদী এই মানুষটার কাছে মৃত্যুচিন্তা একেবারে নস্যি । তারপরও কেন-জানি মৃত্যুর পরবর্তী জীবনটার প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা, দায়বদ্ধতা ও সুখানুভূতি তৈরি হয়েছে আমার ।
কেবলই মনে হয় তোমার আর আমার মাঝে যে মানবপ্রাচীর বিদ্যমান তার দৃশ্যমান ব্যবধান ঘোচানোর জন্য মরণোত্তর জীবনের ভাবনাটাকে কিঞ্চিৎ প্রাধান্য দেওয়া একান্ত আবশ্যক বৈকি ।
বেশ কিছুদিন পূর্বে কার কাছে যেন শুনেছিলাম, তুমি স্বামী-সন্তান নিয়ে বেশ ভালো আছ । কাড়ি কাড়ি টাকা, গাড়ি-বাড়ি, বাহ্যিক আর বৈষয়িক ভালো থাকাটা এখনো যে তোমাকে আগের মতোই আহ্লাদিত করে তা শুনে কিছুটা আহত হয়েছিলাম বটে কিন্তু তোমার ভালো থাকার খবরটা অনেক বেশি শক্তিবর্ধক ছিলো প্রাণহীন এই মানুষটার কাছে ।
হঠাৎ করেই যদি আমি একটি পা’ হারিয়ে ফেলি’ এমনি করেই কী তুমি আমাকে ভালোবাসবে ? খানিকটা হেঁয়ালির ছলে এই প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছিলাম তোমাকে—উত্তরে তুমি কিছুই বলতে পারছিলে না । আমার মুখ তোমার সব শক্তি দিয়ে চেপে ধরেছিলে আর সমানে কাঁদছিলে । তোমার অশ্রর সাতকাহন সেদিন আমার বুঝা হয়ে ওঠেনি । অশ্র বিসর্জন কতটা সহজ, কতটা মূল্যহীন এবং কতটা নান্দনিক তা বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছি আমি এখন ।
গোসসা করে একবার তুমি টানা চার ঘণ্টা ঝড়বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলে আর অশ্রর সখ্যতায় থর থর করে কাঁপছিলে, তোমার সেই কাঁপন এখনো অহর্নিশ রাত-বিরাতে আমাকে দাবড়ে বেড়ায় । যৎসামান্য পা’ কেটে গিয়েছিলো একবার আমার; খবরটা শুনে, পারলে তোমার একটা পা’ই দিয়ে দাও আমায় । লক্ষ্মী আমার, এত মমতার ছড়াছড়ি—কোথায় পাবো আমি আবার ।
তোমাকে জানিয়ে রাখি, আমি বিয়ে করেছিলাম । ভদ্রমহিলাকে আমি তেমন কিছু দিতে পারিনি । আসলে আমার দেওয়ার মতো কিছু ছিল না । প্রেমে পড়া কী অথবা প্রেমে পড়লে কী হয় তা বোধ করি আজ অবধি ভালোভাবে জানি না আমি ।একবার তোমার ভীষণ জ্বর হয়েছিল, আমি বারবার নিজের মাথায় হাত দিতে লাগলাম, না দেখলাম আমি ঠিক আছি কিন্তু আমার পা’ মাটিতে এলোমেলোভাবে পড়ছিল বোধ হয় । ছোটবেলা থেকেই আমি নিষ্ঠুর প্রকৃতির স্বার্থপর; কালক্ষেপণ না করেই অথবা তোমার কথা না ভেবেই সদর হাসপাতালে চলে গেলাম । ডাক্তার আমাকে বলল, আপনি হাঁটছেন কীভাবে, আপনার তো ১০৪ জ্বর ! আমি বললাম না স্যার, আমার শরীর তো ঠাণ্ডা, শীতল । তখন ডাক্তার আমাকে বললেন, আপনি মানসিকভাবে অসুস্থ । ডাক্তারের এই সার্টিফিকেটের পরে, প্রেমের কিছু সংজ্ঞা আমি আবিষ্কার করেছিলাম যদিও তা এখনো খোলসে বন্দী এবং অস্পষ্ট কোনো ধ্রবতারা ।
আমার জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছি । কিছু বুঝে উঠার আগেই মাকেও হারালাম । না’ কোনো আশ্রয়, কোনো সান্ত্বনা, সস্তা কোনো করুণা আমার কপালে জোটেনি । পথ, পথের ধুলা, জীবন এবং জীবিকা—এর মধ্যেই আমার সকল সীমাবদ্ধতা আজ অবধি বন্দী । লেখাপড়ার অদম্য আকুতির কারণে ভাতের হোটেলে চারবছর মেসিয়ারের কাজ করেছি । একটু বড় হবার পর মানুষের বাড়িতে জায়গির থাকতাম । বেঁচে থাকার সুখ কী অথবা প্রাপ্তি কী, আমি আসলে বুঝতাম না তখন । এরপর তুমি এলে । বিধাতা পরম মমতায় তোমাকে আমায় দান করলো । দখিনা বাতাসে যেইদিন আমি তোমার কোলে মাথা রাখলাম; সেইদিন আমার বোধেও আসলো—আমিও অন্য মানুষের মতো একজন মানুষ ।
বিধাতার সুচারু নিয়মের আবশ্যিক বলয়ে মানুষের প্রেম বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে যায় । বাবা-মা, ভাইবোন, প্রেমিক-প্রেমিকা অথবা সব রকমের আপনজনের জন্য মানুষের এহেন ভালোবাসা, আবেগের প্রচণ্ডতা, সত্তাগত দায়বদ্ধতা অভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্নরুপে প্রদর্শিত হতে থাকে । আপনজন বলতে এই ধরণি তলে আমার কেউ ছিল না । সুতরাং আমার মধ্যে যা আছে, তার সর্বস্ব নিংড়ে দিয়ে আমি তোমাকে আঁকড়ে ধরেছিলাম । হয়ত পৃথিবীর অদ্ভুত কিছু জটিল সমীকরণে তা আমি ধরে রাখতে পারিনি কিন্তু তাতে এই অধমের কিচ্ছু যায়-আসে না । জগতের কিছু তাত্ত্বিক, আত্মিক এবং তান্ত্রিক জটিলতায় আমি তোমায় আমার করে রাখতে পারিনি সত্য কিন্তু আমার রক্ত ! আমার রক্তকে যেমন আমি অস্বীকার করতে পারি না; ঠিক তেমনি তোমার সশরীরই কিংবা অশরীরী অস্তিত্ব ধুয়ে-মুছে ফেলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে পারিনি অথবা একই ছাদের নিচে রাজ্যের সব বিশ্বাসকে পুঁজি করে ঘন ঘন অভিমানের খেলায় মেতে উঠে তোমায় আত্মিক প্রশান্তি এনে দিতে পারিনি অথবা যান্ত্রিক এই ধরণি তলে পারিনি যন্ত্রের মতো স্বামী-স্ত্রীর অনিন্দ্যসুন্দর, নয়নাভিরাম অধিকারগুলোকে বাস্তবে রূপায়ণ করতে । লক্ষ্মী, সশরীরে অথবা সরাসরি কাছে পেতে হবে, তোমাকে আমার কাম-বাসনার সঙ্গী হতে হবে অথবা তোমার স্যাঁতসেঁতে আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছে দিতে হবে নইলে তুমি আমার নও, এমন কোনো কথা আমি অন্তত মানি না ।
আমার থেকে তোমাকে বাদ দেওয়া হলে, আমার অবশিষ্ট কিছু থাকে, তুমি বলো ? এই তো আর মাত্র কয়েকটা দিন । তারপর মৃত্যুর ধূসর সুন্দর, অনন্ত জগৎ । তারপর তুমি-আমি, আমি-তুমি । ময়না আমার, তোমার সব ছবি আমি পুড়িয়ে ফেলেছি । ওটার আমার কোনো দরকার নেই। আমি তোমাকে এমনিতেই ঢের দেখি । সোনামানিক, জান, লক্ষ্মী আমার—তুমি ভালো থেকো, অনেক, অনেক ভালো ।