আমার একটা বদভ্যাস আছে | মুহাম্মাদ ইমরানের কবিতা | Amar Ekta Bodovvas Ache | Muhammd Imran |

আমার একটা ভয়ংকর বদভ্যাস আছে
দুপুর এলেই আমি
এলিয়ে দুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

কিন্তু আজ ঘুম নামক ছলনার প্রশান্তি
তার সহজাত তাণ্ডব চালাতে পারেনি
নির্লজ্জ, বেহায়ার মতো বহুক্ষণ
আমি অবাক হয়ে বসে ছিলাম !

অনেক ক্ষমতা তোমার, না !
কী করতে পারো তুমি ?
অকর্মা, অথর্ব, হতচ্ছাড়া
কোনো বেকারকে
ভুল করে একটা ভুল স্বপ্ন
দেখাতে পেরেছ ?

সবুজ-অবুঝ, ন্যায়ের বাণে,
অন্যায়ের তোপে
তোমাকে কোথাও পাওয়া যায় না ।

সৃষ্টি, দৃষ্টি, বৃষ্টি, অনাচার, অত্যাচার,
হত্যায়, লোভে, ক্রোধে, ভুলের ভুলে,
গরিমায়, গৌরবে, ত্যাগে—
কোথায় আছ তুমি, বলো তো দেখি ?

সূর্যের আলো দেওয়া কী বন্ধ হয়ে গেছে ?
চাঁদের অল্পস্বল্প আলোর মূর্ছনায়
নবদম্পতির নয়নাভিরাম
মাদকাসক্ত ঢলাঢলি কী থমকে গেছে ?

কই খুনোখুনি তো বন্ধ করতে পারোনি
এমনকি চুরুটের শেষ টানের সুখটা
পর্যন্ত রুখতে পারো নি,
শুধু পেরেছ, আমার মতো একটা
নির্ভেজাল অপদার্থর সাথে ।


১৯ ০৪ ১৬

ছড়িয়ে দিন ইচ্ছেমত

প্রিয় খোকা | মুহাম্মাদ ইমরান | Prio Khoka | Muhammad Imran |

আশ্রম থেকে বাবার খোলা চিঠি

প্রিয় খোকা

ইদানীং স্মৃতিগুলো বড্ড বেশি বেয়াড়া হয়ে গেছে । তারা রীতিমত প্রতারণায় মত্ত । স্মৃতি হাতড়ে বহুদূর চলে যাই তারপরও তোকে খুঁজে পাই না । বয়সের ভারে অনেক স্মৃতিই এখন ধূসর কোনো কাব্যিক সংস্করণ । বাজান’ তোর মনে আছে, ছোটবেলায় তোর বুক আমার বুকের সাথে না মিশালে তোর ঘুম আসত না ।

প্রায়ই তুই মাঝরাতে জেগে উঠতি । আমি সারারাত কত সব অদ্ভুত গল্প শুনাতাম । জানিস বাবা, আমার এখনও সব গল্প দিব্যি মনে আছে; একই ধরনের কাহিনী বারবার বলাতে’ বোধ হয় আÍস্থ হয়ে গিয়েছিল । মনে আছে বাবা, মেট্রিক পরীক্ষার সময় তোর একবার কালাজ্বর হয়েছিল ।পীর বাবার কাছে তোর নিথর দেহখানি নিয়ে গিয়েছিলাম; হুজুরকে আমি ডাক দিয়ে বললাম, প্রভুর কাছে আপনি একটু দোয়া করেন যেন আমার বদলে আমার বাজান বেঁচে থাকে ।

বৌমা, দাদু ভাইয়েরা কেমন আছে ? বৌমাকে তুই ভুল বুঝিস না । সে তো আমাদের রক্তের কেউ না । আমার জন্য চিন্তা করিস না । এই আশ্রমে আমি বেশ ভালো আছি । আমরা সব দিয়ে জনা পঞ্চাশেক বাবা আছি এখানে । এদের মধ্যে আমি বোধ হয় মানসিক দিক দিয়ে একটু ঢের অবস্থানে আছি; ওই হতভাগারা বেশির ভাগই ছেলে বা ছেলের বউর হাতের চড়-থাপ্পড়, লাথিগুতা খেয়ে এই আশ্রমে পাড়ি জমিয়েছে, সেই দিক দিয়ে আমি তোর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ ! আমার  সে রকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি, বোধ হয় ।

তুই যখন আমাকে আশ্রমে দিয়ে গেলি, আমি কিন্তু খুব স্বাভাবিক ছিলাম । আমি তোকে এত বেশি  ভালোবাসি যে তোর আশ্রমে দেওয়াটাকেই আমার কাছে অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে । বাজান আমি জানি, আমার জন্য তোরও খারাপ লাগে; না বাবা’ মন খারাপ করিস না । আশ্রমে দেওয়া ছাড়া তোর আর কী-ই বা করার ছিল ?

জানি না কী হয়েছে, ইদানীং প্রায়ই তোর মাকে স্বপ্ন দেখি । কী কারণে যেন মৃত্যুকেই আমার সবচাইতে আপন মনে হয় । মনে হয়, মৃত্যুই হতে পারে আমার সাঁঝের মায়া । মৃত্যুই কেবল পারে পৃথিবীর দুর্গন্ধময় বাড়তি এই উপদ্রবকে থমকে দিতে ।

আমি মারা যাওয়ার পর তোর বেশ কিছু পয়সা খরচ হবে । দাফন-কাফন, মিলাদ, চলি­শা আরও কত কি ? অহেতুক টাকা খরচ করার জন্য বৌমা বোধ হয় তোকে অনেক বকবে । বাজান তুই ভালো থাকিস । তুই  বড় হয়ে যাওয়ার কারণে তোকে জড়িয়ে ধরে বহুকাল চুমু খাওয়া হয় না । আমার মৃত্যুর পর পারলে তুই সেই কাজটি করিস

                                                                            ইতি—               

তোর হতভাগ্য পিতা

ছড়িয়ে দিন ইচ্ছেমত

ফিরে এসো নন্দিনী | মুহাম্মাদ ইমরানের কবিতা | Fere Eso Nondini | Muhammad Imran |

শ্রাবণের কান্নাভেজা রাতে
চৌত্রের খরতাপে মিশে
গোধূলির বিষণ্ণ বেলায়’ ফিরে এসো
ফিরে এসো শরতের এক স্নিগ্ধ সকালে
আয় ফিরে আয় বসন্ত’ আর একটিবার
দাও দাও দাও মরণের অধিকার ।

কাকডাকা ভোরে
নয় তো ঘোর তিমিরে
উদাস দুপুরে ফিরে আসো
ফিরে এসো সন্তানহারা মায়ের
চোখের জলে বেয়ে ।

আমি রাখতে পারিনি তোমার মান
লক্ষ্মী তুমি করো না অভিমান ।
আসবে তুমি আসবে
সত্যি আবার ফিরে
চার বেহারার পালকি
আর কলেমার ধ্বনিতে ।

ছড়িয়ে দিন ইচ্ছেমত

শুধু একটা মানবীর জন্য | মুহাম্মদ ইমরানের কবিতা | shudhu Ekta Manobir Jonno | Muhammad Imran

আমি জানতে চাই
আমাকে আর কী করতে হবে ?
কী করলে আমার মুক্তি মিলবে
আমার স্বাভাবিক প্রায়শ্চিত্ত জুটবে
আমি জানতে চাই ?

একটাই তো মানবী অথচ কত শ্রম !
কখনও চৌত্রের খরতাপে পুড়তে পুড়তে
অঙ্গার হয়ে গিয়েছি ।
কখনো বৃষ্টি অথবা শিলাবৃষ্টি হয়ে
তামাম দুনিয়াকে ভিজিয়ে দিয়েছি
অথচ পারলাম না আমি ভিজতে !

এখনও নষ্ট দুপুরে আঁতকে উঠি
লাজুক বিকেলকে নির্লজ্জর মতো
এড়িয়ে যাই, গভীর রজনীতে
নিজেকে নিজে, সান্ত্বনা দিতে দিতে
সান্ত্বনা শব্দটার প্রতি ঘেন্না ধরিয়ে দেই ।

কী না করেছি আমি !
হুজুরের বশীকরণ তাবিজ
কবরের পর কবর পুঁতে যেতাম;
কালো কুকুর, মরা ঘাট, আম গাছ,
ডালিম গাছ, শুকুর ফকির থেকে শুরু করে
মৌলভিডাঙ্গার পীর সাব’
কার কাছে যাইনি আমি ?

একজন সাধারণ মানুষের মতো বেঁচে
থাকার আকুতি নিশ্চয়ই
অসাধারণ কিছু নয় ?
সেই সাধারণের সুখানুভূতির সত্তাটুকুন
কতটা মূল্যে খরিদযোগ্য
আমি জানতে চাই ?

আমি স্নিগ্ধ ভোর পরখ করতে চাই
রোদেলা দুপুরে অবসাদে ভরা
একখানা ঘর্মাক্ত ঘুম চাই।
গোধূলির বিষণ্ণতা
চড়া দামে কিনতে চাই ।

হেঁয়ালি বিকালে বেখেয়ালে
হারিয়ে যেতে চাই ঐ দূর দিগন্তে।
রঙধনুর লীলা দেখে চিৎকার করতে চাই
রাত ১০ টা হলেই সুবোধ বালকের মতো
তন্দ্রার ঘোরে হারিয়ে যেতে চাই ।

খুব সাধারণ হয়ে বেঁচে থাকার জন্য
আমাকে কী কী জলাঞ্জলি দিতে হবে
বিনয়াবনতার সাথে আমি জানতে চাই ?

ধ্বস্ত, জীর্ণ, নষ্ট, পচা, গলা
একটাই তো মানবী অথচ
আমি কত রুগ্ন, কত অসহায় !


১৬ ০৭ ২০১৬

ছড়িয়ে দিন ইচ্ছেমত

নিমাইর লকডাউন | মুহাম্মাদ ইমরানের কবিতা | Nimair Lockdown | Muhammad Imran |

সুদখোরদের মতো
নিমাইর গচ্ছিত কোনও টাকা নেই ।
কাম করলে খায়, কাম না করলে–?
১ বউ, ০২ কন্যা আর বুড়ো মাকে নিয়ে
ওরা মোট ০৫ পেট ।
০৫ পেটের কামাইছুত নিমাই একাই ।

বছর কুড়ি আগে
আলীপুর মোড়ে নিমাই তাবিজ বেচত ।
আয়-রোজগার তখন মন্দ ছিল না
ঠাকুরের দোকান থেকে মায়ের জন্য
রসগোল্লাও আনা হতো অকস্মাৎ ।
তাবিজের চল উঠে যাওয়ায়
নিমাই বছর কয়েক মাটি কেটেছে
কয়েক-বসন্ত রাজমিস্ত্রির জোগালদারও ছিল ।

এতিম নিমাইর জগাই নামে এক ভাই ছিল
৭১ পরবর্তী সময়ে
রক্ষীবাহিনীর হাতে ভিটেমাটিসহ
জগাইকেও জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে ।

নিমাইর বড় মেয়ে ইলিশে মন্ত্রমুগ্ধ
মাছবাজারের চারিপাশে
নিমাই চোরের মতো ঘুরে ।
ইলিশের দর আর নিমাইর লুঙ্গির গোঁজ
ভবেরহাটের দুই মেরুর অবস্থান ।

এখন নিমাই অটোভ্যান চালায়
মহাজনের জমা দেওয়ার পরও
৩০০/৫০০ থাকে ।
ভালো খেতে না পারলেও
০৫ পেট চলে যায় ।
চলে যেতে হয় ।

করোনা বা লকডাউনের
জুতসই কোনও সংজ্ঞা
নিমাইর জানা নেই।
বোধ হওয়ার পর থেকে নিমাইর একটাই মন্ত্র—
কামলা দিতে পারলে ০৫ পেট চলবে
নয়-তো ?

নিমাই কী ভ্যান চালায় না পেট চালায়
তা ওর ভোঁতা মীমাংসায় ছোঁয় না ।
লকডাউনকালে নিমাই ১০০০ টাকা করে
অদ্যাবধি ০৩ বার জরিমানা গুনেছে।
নিমাই ক্ষীণ এবং হীন সুরে ম্যাজিস্ট্রেটকে
অত্যল্প বোঝাতে চেষ্টা করেছে—
করোনা, লকডাউন, মাস্ক, ঘরে থাকা,
হাত ধোয়া, গাও ধোয়া
সবই অধম মেনে নিবে;
শুধু আমার ০৫ পেট ভরে দেবার নিশ্চয়তা দেন।
ফলাফলঃ পুলিশের চড়-থাপ্পড়,
পাবলিকের ট্যাক্সের টাকায় কেনা
সরকারি বুটের পাইকারি লাথি
এবং ম্যাজিস্ট্রেটের দস্তখতসহ
১০০০ টাকার জরিমানার স্লিপ ।

হরিপদ নামে নিমাইর এক স্কুল-মাস্টার বন্ধু আছে ।
হরিপদ নিমাইকে বলেছে—
বিদেশে লকডাউনের সময়
সরকার ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেয় ।
নিমাইর সরল কোরাস—
গতর থাকতে পরেরটা আমার লাগবে না কিন্তু
সরকার উল্টো ৩০০০/= নিয়ে নিলো, কেন ?

০১ জুলাই থেকে তীব্র লকডাউন চলছে
দেখা মাত্রই গ্রেফতার !
গ্রেফতারের ডর
নিমাই-অবধি পৌঁছানোর সুযোগ নেই ।

ভাবলেশহীন নিমাই
ভ্যান নিয়ে বের হয়ে পড়েছে ।
চুরি-চামারি করে
যদি দু-এক খ্যাপ মারা যায় ?
কিন্তু আজ আর তা হলো না

পুলিশ এবং আর্মির যৌথ অভিযানে
নিমাইকে আটক করা হলো ।
একই অপরাধ বারবার করায়
নিমাইকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট
০৬ মাসের জেল দিয়ে দিলো ।

নিমাইর চোখেমুখে আন্ধার ।
০৬ মাস না
আমাকে ৬০ বছরের জেল দেন।
আমি না আসা পর্যন্ত
শুধু আমার বাড়ির ০৪ পেট
ভরার ব্যবস্থা করে দেন ।
পুলিশ আর বসে থাকতে পারল না ?
স্যারের সাথে বেয়াদবি ! মুখে মুখে তর্ক !
বানচোদ, শালা মালাউনের বাচ্চা
বলতে বলতে এবং সমানে লাথি মারতে মারতে
নিমাইকে গাড়িতে উঠিয়ে ফেললেন ।
নিমাইর অশ্রুকবলিত দুটি চোখে হরেক প্রশ্ন ?
না-বলা অভিমানের স্তূপ ?

কমিশনার,ম্যাজিস্ট্রেট, মেয়র, ডিসি, সচিব,
চিত্তশালী, বিত্তশালী, রক্ষণশীল, প্রগতিশীল,
সুশীল, মোড়ল, কামলা, মাদবার, মৃদুভাষী,
স্পষ্টভাষী, মন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী
এবং লিঙগহীন আন্দোলনপ্রিয় জনগণ—
সবার কাছে নিমাইর অব্যক্ত আবেগের
দ্ব্যর্থহীন এবং শর্তহীন প্রশ্ন—
আমার অবর্তমানে
আমার ০৪ পেটের দায়িত্ব নিবে কে ?


০৪ ০৭ ২১

ছড়িয়ে দিন ইচ্ছেমত

আবার আমি পাই যদি তাঁরে ? মুহাম্মাদ ইমরানের কবিতা | Abar Ami pai Jodi Tare | Muhammad Imran

সেই আটটি বছর আগে
হারিয়ে ফেলেছি যারে
চলছে দায়মোচন, অভিশাপ আর
অশ্রুর নীরব সাতকাহন ।

নিদ্রায় যাওয়ার আগে
রুটিন করেই ভেবে রাখি,
সকাল হতেই আসিত যদি ফিরি,
আসিত যদি কলিজার-টুকরা মানিক আমার
মোর শ্মশানপুরের গেহখানি জুড়ি ।

অথবা বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেত
সোনালী সোনালী আকাঙ্খার চারণভূমি
কৃষাণের অনিন্দ্যসুন্দর স্বপ্নের
আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে
আবার আমি পাই যদি তাঁরে ।

অথবা ব্যস্ততার এক নীরস দুপুরে
দস্যুপনা গিয়েছে হারিয়ে
উদাসী বনের ধারে;
নির্বাক, নির্লিপ্ত, অসহায় আমি
গোধূলির বিষণ্ণতায়
মিলিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ব্রত…

হঠাৎ করেই পেছন থেকে ঝাপটে ধরে
আমায় যদি বলে—
শরীরের এ কী হাল করেছ তুমি
নাওয়া-খাওয়া হয়নি ক’দিন ধরে ?

কেতাদুরস্ত ভড়কে যেয়ে
আমায় যদি বলে, কী করেছ তুমি !
কী করেছ মানিক আমার
চোখের নিচে কালি কেন
ঘুমাও-না’ ঠিক মতো ?
চুলগুলো এলোমেলো কেন
পায়ের নখ বড় কেন
ঘামের গন্ধ আসছে কেন
করবোটা কী আমি তোমারে
এই ছিল আমার কপালে !

এত শত অধিকার যার
কোথায় পাই, তাঁরে আমি আবার ?
একি আবোল-তাবোল লিখে চলেছি
না কি অন্ধকার এক ঘোরে
বুঁদ হয়ে আছি !

আচ্ছা, পা হতে মাথা অব্দি
নেই কোথা সে ?
দৃশ্যত সে কাছে নেই
তাতে হয়েছেটা কী ?
আমা থেকে তাঁকে বাদ দিলে
আমাতে আর থাকেটা কী ?


২৮ ৫ ২০১৫

ছড়িয়ে দিন ইচ্ছেমত

জান | মুহাম্মাদ ইমরানের কবিতা | Jan | Muhammad Imran |

কাল আচমকাই মধ্যরাতে তুঁই হানা দিলি
তোর মিষ্টি গন্ধটা অনুভব করছিলাম
কেমন যেন তোঁর নিঃশ্বাসের ফিসফিসানি
আমার পুরো কলিজাটা জুড়ে বয়ে বেড়াচ্ছিল ।

শুনলাম তুঁই সুখে আছোস।
তোঁর সুখে থাকাটা আমার স্পন্দন
সচল রাখার জন্য কতটা জরুরি
তা তুঁই ভালো করেই জানোস !

আমার জন্য ভাবিস না
তোঁর নিঃশ্বাসের গন্ধটা
আমি আমার বিশ্বাসের মধ্যে
অনেক শক্ত করে পুঁতে রেখেছি
আশা করি,
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভালোই থাকবো ?


তোঁর জান

ছড়িয়ে দিন ইচ্ছেমত

মা কেন এমন ? মুহাম্মাদ ইমরানের কবিতা | Ma keno Emon | Muhammad Imran |

কী-রে একি তামাশা আজব
জ্বর হয় আমার
চেয়ে দেখি
আমার চেয়ে বেশি জ্বর মার ।
ঘুম নেই মার চোখে
একটু পরপরই তার
বাজানের মাথায় হাত রেখে
কী যেন কী দেখে ?

পরীক্ষায় ফাস্ট হলাম আমি
খেলায়ও জিতলাম আমি
অথচ ফাস্ট হলো মা
কই জিতলাম আমি
জিতলও যেন মা ।

মেলে না উত্তর
ভাবি বসে নিরালা
চারপাশে চালাকদের বুদ্ধি ফাঁদা
দিগন্ত জুড়ে মানুষ-বেশে
জানোয়ারের গাঁদা ।
এত ছ্যাঁচড়ের ভিড়ে
কোন সে কারিগর
এমন মা দিলো পরান ভরে ।

ওহ্‌ পেয়েছি পেয়েছি’
মা-তো আলাদা কিছু নয়
অভিন্ন আত্মা, একই সত্তা
নাড়িটাও যে ছিলো এক
কোথা থেকে ধাত্রীবেটি এসে
দিয়ে গেলো করে ফারাক ।

বসে খাবার টেবিলে
মুরগির রান আর
মাছের মাথা খাই সমানতালে;
মার হাসিতে বিরল মুগ্ধতা
মাথা খাই আমি, মা খাচ্ছে মমতা ।

যদি বলি
রুই মাছের মাথাটা
আজকে কী খাওয়া যায় না, মা ?
মার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে
ভাবটা এমন, সে খেলে
পৃথিবী ধ্বংসও হতে পারে ।
খেয়েছি, পরে খাব, আর একদিন খাব
অথবা এমন কথা বলে না বাপ;
সারাবছর সব মার-ই একই উত্তর ।
এভাবেই চলছে জনম দুঃখিনীর আয়ুষ্কাল
এভাবেই চলছে মা-দের দিনকাল ।

চুপটি মেরে ভাবি বসে একেলা
মা কেন এমন ?
এমন স্বার্থ উদ্ধারের মিছিলে
এই ভদ্র মহিলাকে
কে পাঠালো, এই চির অভাগার তরে ?


২৫ ৬ ১৮

ছড়িয়ে দিন ইচ্ছেমত

হাসু আপা | মুহাম্মাদ ইমরান | Hasu Apa | Muhammad Imran |

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বায়েজিদের কাছে লিখা হাসু আপার ব্যথার কাজলে মাখা একটি চিঠি ।

প্রিয় বায়েজিদ

সংসার নামক এক অদ্ভুত ধর্ম পালন করিতেছি প্রায় বছর সাতেক । তবে সত্য কথাটা হইলো এখনো আমি তোমার বাহিরে তেমন কিছুই ভাবিতে পারি না । জানি এটা অন্যায় তারপরও এটাই আমার কাছে ন্যায় । কোনোরকম কারণ ছাড়াই মানুষ বড় বেশি স্বার্থপর । মানুষ সবচাইতে ভালোবাসে তার নিজেকে আর আমার নিজ বলিতে কিছুই নাই । তোমার আর আমার মাঝে ফাঁক খোঁজাটা মৃত্যুর পরেও আমার দ্বারা সম্ভব নয়; সেই সুখানুভূতির মায়াবী ছলনাটুকু বেশ ভালোভাবেই আঁকড়াইয়া ধরিয়া আছি, যাহার কারণে এখনো দিব্যি বাঁচিয়া রহিয়াছি ।

তুমি জানো কি না জানি না, ইতিমধ্যে আমার একটা বাচ্চা হইয়াছে । আমার স্বামীটাও বেশ । মনে হয়, অনেকের চাইতেই ভালো আছি তারপরও নিজেকে কেমন যেন রোবটের মতো লাগে । মনে হয় যান্ত্রিক এই সভ্যতায় আমি নিজেও পুরোদস্তুর যন্ত্র হইয়া গিয়াছি ।

খুব সকালে ঘুম হইতে উঠিতে হয় । বাচ্চাটাকে স্কুলে লইয়া যাই । অতঃপর ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্কুলের করিডরে বসিয়া থাকি। যদিও আমি একা নই, আমরা সব মা’ই বসিয়া থাকি । আশ্চর্যজনক বিষয়টা হইলো, প্রত্যেকটা মহিলাই শুধু নিজেদের কথাই বক বক করিয়া বলিতে থাকে । কাহারও কথা কাহারও শোনার বিন্দুমাত্র সময় নাই ।

আমার স্বামী বেশ রাত করিয়া বাড়ি ফিরে । আমরা একই ছাদের নিচে থাকিলেও ভাবখানা এমন যেন কেউ কাউকে চিনে না । যদিও এর জন্য আমিই  ঢের দায়ী। আমরা যে যার মতো ব্যস্ত ।  রুটিনমাফিক এই জীবনে আমি ক্লান্ত এক পথিক’ আপাতত খেই হারাইয়া ফেলিয়াছি । দিন যাচ্ছে আর আমিত্বর কাছে ক্রমশ হারাইয়া যাইতেছি ।

তোমার প্রতি তেমন কোনো অনুযোগ আমার নাই । তোমাকে আমি যখন বলিয়াছিলাম, বাবা আমার জন্য ছেলে খুঁজিতেছে, তাড়াতাড়ি কিছু একটা করো । তোমাকে না পাইলে আমার বাঁচিয়া থাকা মুশকিল হইবে । সেই সময়টায় রাজ্যের সব অসহায়ত্ব কেন তোমাকে গ্রাস করিয়াছিল তাহা বোধ করি আজ অবধি আমার অজানা ।

মাঝে মাঝে তুমি এমন করিতে যেন তোমার রক্তের মধ্যে আমার নিঃশ্বাসের ফোয়ারা বহিতেছে । তুমি কী সেইটা সত্যি সত্যি করিতে নাকি অভিনয় করিতে তাহা আমি জানি না । আমি আমার আবেগ তোমার মতোন করিয়া প্রকাশ করিতে পারিতাম না; এর একটা কারণ আমি নারী আর একটা বোধ হয়, তোমার প্রতি অতিশয় আসক্তি যার প্রলয়ঙ্করী প্রভাব আমাকে নির্বাক, নিথর, নিস্তব্ধ করিয়া দিয়াছিল।

এখনো তোমার অনেক স্মৃতি আমাকে আহ্লাদিত করিয়া চলিয়াছে । প্রায় প্রত্যেক রাতেই তুমি আমার চোখের নোনাজলে হারাইয়া যাও । আমি সব জানি। তুমি ভালো মানুষ নও । আমি জানি,  আমার স্বামী প্রতারণার ফাঁদে আটকা পড়িয়াছে । তুমি আমার দুর্বলতাকে উপহাস করিও না । মোটেও ভাবিয়ো-না  আমি পাগল হইয়া গিয়াছি ? আমি নিজেকে অনেক ভালোবাসি, তাই তোমাকে ভালোবাসি এবং বাসবো ।

ইতি—

তোমার  হাসু

ছড়িয়ে দিন ইচ্ছেমত

অনিমেষের ছাড়পত্র | মুহাম্মাদ ইমরান | জগৎশ্রেষ্ঠ এক চিরকুট | Onimesher Charpotro | Muhammad Imran |

জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে প্রবাসী অনিমেষ বাবুর আকাশের ঠিকানায় লিখা রক্তস্নাত একখানা ছাড়পত্র ।

লক্ষ্মী আমার,

ইদানীং মৃত্যুকে নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ । যদিও জীবনবাদী ও সুবিধাবাদী এই মানুষটার কাছে মৃত্যুচিন্তা একেবারে নস্যি । তারপরও কেন-জানি মৃত্যুর পরবর্তী জীবনটার প্রতি এক ধরনের  শ্রদ্ধা, দায়বদ্ধতা ও সুখানুভূতি তৈরি হয়েছে আমার ।

কেবলই মনে হয় তোমার আর আমার মাঝে যে মানবপ্রাচীর বিদ্যমান তার দৃশ্যমান ব্যবধান ঘোচানোর জন্য মরণোত্তর জীবনের ভাবনাটাকে কিঞ্চিৎ প্রাধান্য দেওয়া একান্ত আবশ্যক বৈকি ।

বেশ কিছুদিন পূর্বে কার কাছে যেন শুনেছিলাম, তুমি স্বামী-সন্তান নিয়ে বেশ ভালো আছ । কাড়ি কাড়ি টাকা, গাড়ি-বাড়ি, বাহ্যিক আর বৈষয়িক ভালো থাকাটা এখনো যে তোমাকে আগের মতোই আহ্লাদিত করে তা শুনে কিছুটা আহত হয়েছিলাম বটে কিন্তু তোমার ভালো থাকার খবরটা অনেক বেশি শক্তিবর্ধক ছিলো প্রাণহীন এই মানুষটার কাছে ।

হঠাৎ করেই যদি আমি একটি পা’ হারিয়ে ফেলি’ এমনি করেই কী তুমি আমাকে ভালোবাসবে ? খানিকটা হেঁয়ালির ছলে এই প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছিলাম তোমাকে—উত্তরে তুমি কিছুই বলতে পারছিলে না । আমার মুখ তোমার সব শক্তি দিয়ে চেপে ধরেছিলে আর সমানে কাঁদছিলে । তোমার অশ্রর সাতকাহন সেদিন আমার বুঝা হয়ে ওঠেনি । অশ্র বিসর্জন কতটা সহজ, কতটা মূল্যহীন এবং কতটা নান্দনিক তা বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছি আমি এখন ।

গোসসা করে একবার তুমি টানা চার ঘণ্টা ঝড়বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলে আর অশ্রর সখ্যতায় থর থর করে কাঁপছিলে, তোমার সেই কাঁপন এখনো অহর্নিশ রাত-বিরাতে আমাকে দাবড়ে বেড়ায় । যৎসামান্য পা’ কেটে গিয়েছিলো একবার আমার; খবরটা শুনে, পারলে তোমার একটা পা’ই দিয়ে দাও আমায় । লক্ষ্মী আমার, এত মমতার ছড়াছড়ি—কোথায় পাবো  আমি আবার ।

তোমাকে জানিয়ে রাখি, আমি বিয়ে করেছিলাম । ভদ্রমহিলাকে আমি তেমন কিছু দিতে পারিনি । আসলে আমার দেওয়ার মতো  কিছু ছিল না । প্রেমে পড়া কী  অথবা প্রেমে পড়লে কী হয় তা বোধ করি আজ অবধি ভালোভাবে জানি না আমি ।একবার তোমার ভীষণ জ্বর হয়েছিল, আমি বারবার নিজের মাথায় হাত দিতে লাগলাম, না দেখলাম আমি ঠিক আছি কিন্তু আমার পা’ মাটিতে এলোমেলোভাবে পড়ছিল বোধ হয় । ছোটবেলা থেকেই আমি নিষ্ঠুর প্রকৃতির স্বার্থপর; কালক্ষেপণ না করেই অথবা তোমার কথা না ভেবেই সদর হাসপাতালে চলে গেলাম । ডাক্তার আমাকে বলল, আপনি  হাঁটছেন কীভাবে, আপনার তো ১০৪ জ্বর ! আমি বললাম না স্যার, আমার শরীর তো ঠাণ্ডা, শীতল । তখন ডাক্তার আমাকে বললেন, আপনি মানসিকভাবে  অসুস্থ । ডাক্তারের এই সার্টিফিকেটের পরে, প্রেমের কিছু সংজ্ঞা আমি আবিষ্কার করেছিলাম যদিও তা এখনো খোলসে বন্দী এবং অস্পষ্ট কোনো  ধ্রবতারা ।

আমার জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছি । কিছু বুঝে উঠার আগেই মাকেও হারালাম । না’  কোনো আশ্রয়, কোনো সান্ত্বনা, সস্তা কোনো  করুণা আমার কপালে জোটেনি । পথ, পথের ধুলা, জীবন এবং জীবিকা—এর মধ্যেই আমার সকল সীমাবদ্ধতা আজ অবধি বন্দী । লেখাপড়ার অদম্য আকুতির কারণে ভাতের হোটেলে চারবছর মেসিয়ারের কাজ করেছি । একটু বড় হবার পর মানুষের বাড়িতে জায়গির থাকতাম । বেঁচে থাকার সুখ কী  অথবা প্রাপ্তি কী, আমি আসলে বুঝতাম না তখন । এরপর তুমি এলে । বিধাতা পরম মমতায় তোমাকে আমায় দান করলো । দখিনা বাতাসে যেইদিন আমি তোমার কোলে মাথা রাখলাম; সেইদিন আমার বোধেও আসলো—আমিও অন্য মানুষের মতো একজন মানুষ ।

বিধাতার সুচারু নিয়মের আবশ্যিক বলয়ে মানুষের প্রেম বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে যায় । বাবা-মা, ভাইবোন, প্রেমিক-প্রেমিকা অথবা সব রকমের আপনজনের জন্য মানুষের এহেন ভালোবাসা, আবেগের প্রচণ্ডতা, সত্তাগত  দায়বদ্ধতা  অভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্নরুপে প্রদর্শিত হতে থাকে । আপনজন বলতে এই ধরণি তলে  আমার কেউ ছিল না । সুতরাং আমার মধ্যে যা আছে, তার সর্বস্ব নিংড়ে দিয়ে আমি তোমাকে আঁকড়ে ধরেছিলাম । হয়ত পৃথিবীর অদ্ভুত কিছু জটিল সমীকরণে তা আমি ধরে রাখতে পারিনি  কিন্তু তাতে এই অধমের কিচ্ছু যায়-আসে না । জগতের কিছু তাত্ত্বিক, আত্মিক এবং তান্ত্রিক জটিলতায় আমি তোমায় আমার করে রাখতে পারিনি সত্য কিন্তু আমার রক্ত ! আমার রক্তকে যেমন আমি অস্বীকার করতে পারি না; ঠিক তেমনি তোমার সশরীরই কিংবা অশরীরী অস্তিত্ব ধুয়ে-মুছে ফেলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তোমার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে পারিনি অথবা একই ছাদের নিচে রাজ্যের সব বিশ্বাসকে পুঁজি করে ঘন ঘন অভিমানের খেলায় মেতে উঠে তোমায় আত্মিক প্রশান্তি এনে দিতে পারিনি অথবা যান্ত্রিক এই ধরণি তলে পারিনি যন্ত্রের মতো স্বামী-স্ত্রীর অনিন্দ্যসুন্দর, নয়নাভিরাম অধিকারগুলোকে বাস্তবে রূপায়ণ  করতে । লক্ষ্মী, সশরীরে অথবা সরাসরি কাছে পেতে হবে, তোমাকে আমার কাম-বাসনার সঙ্গী হতে হবে অথবা তোমার স্যাঁতসেঁতে আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছে দিতে হবে নইলে তুমি আমার নও, এমন কোনো কথা আমি অন্তত মানি না । 

আমার থেকে তোমাকে বাদ দেওয়া হলে, আমার অবশিষ্ট কিছু থাকে, তুমি বলো ? এই তো আর মাত্র কয়েকটা দিন । তারপর মৃত্যুর ধূসর সুন্দর, অনন্ত জগৎ । তারপর তুমি-আমি, আমি-তুমি । ময়না আমার, তোমার সব ছবি আমি পুড়িয়ে ফেলেছি । ওটার আমার কোনো  দরকার নেই। আমি তোমাকে এমনিতেই ঢের দেখি । সোনামানিক, জান, লক্ষ্মী আমার—তুমি ভালো থেকো, অনেক, অনেক ভালো ।

ইতি—
তোমার অনিমেষ

ছড়িয়ে দিন ইচ্ছেমত